Skip to main content

কারবালা/Karbala

ইমাম  হোসাইনের শাহাদাৎ
---------------------------------------------------------------

৬০ হিজরীর রজব মাসে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া ওফাতের পর ইয়াযিদ মদীনা মুনাওয়ারাহর গভর্ণর ওয়ালিদ বিন উতবার নিকট এই মর্মে পত্র প্রেরণ করে যে, “হযরত ইমাম হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক ইয়াজিদের নিকট বায়’আত হওয়ার স্বীকারোক্তি নামা দ্রুততার সাথে সংগ্রহ কর। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা বায়’আত গ্রহণ না করে,তাদেরকে ছাড়বেনা ।

[ইবনে কাসীর ও তাবারীর বর্ণনায় এসেছে-

فَخُذْ حُسيناً وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ بِالْبَيْعَةِ أَخْذًا شَدِيدًا لَيْسَتْ فِيهِ رُخْصَةٌ حَتَّى يُبَايِعُوا

অর্থাৎ হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম কে এমনভাবে পাকড়াও কর, যেন বাইয়াত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি না পায় ।

হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযিদের বায়’আত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মক্কা মুকাররামায় চলে যান। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট ইয়াযিদ মুসলিম জাহানের ইমাম ও নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিল, বরং; সে ফাসিক, পাপিষ্ঠ, অত্যাচারী ও মদ্যপায়ী ছিল । আর খলিফা হিসেবে তার নিযুক্তিও খোলাফায়ে রাশেদার নৈর্বাচনীক ইসলামী পদ্ধতির পরিপন্থী ছিল। কূফার অধিবাসীগণ ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট একে একে চিঠি এবং প্রতিনিধি প্রেরণ করে আরজ করেন যে, তিনি যেন কূফায় আগমণ করেন। এবং বলে, আমাদের কোন ইমাম নেই।আমরা আপনার নিকটই বায়’আত গ্রহণ করব।

তাদের (কূফাবাসীদের) চিঠি ও দূত প্রেরণের পরিমাণ এতই বেড়ে যায় যে, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মনে হল তাদের দিকনির্দেশনা প্রদান ও ফাসিক পাপিষ্ঠ ইয়াযিদের বায়’আত গ্রহণ হতে রক্ষা করতে তাঁর কূফা যাওয়া প্রয়োজন।

পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য তিনি হযরত মুসলিম বিন আকীল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে কূফায় প্রেরণ করেন। সেখানে সকলে তাকে সাদরে গ্রহণ করল এবং অগণিত লোক তাঁর হাতে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষে বায়’আত গ্রহণ করলো। কিন্তু যখন ইবনে যিয়াদ সকলকে হুমকি প্রদান করল, তারা বায়’আত ত্যাগ করল। আর হযরত মুসলিম বিন আকীল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বন্দী অবস্থায় শহীদ করা হল ।

ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত মুসলিম বিন আকীল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত ও কূফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ মক্কা হতে কূফার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর লাভ করেন ।

সংক্ষিপ্ত ঘটনা হল এই , এই যাত্রায় নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে মোট বিরাশি (৮২) জন শাহাদাত গ্রহণ করেন, যাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও (সামরিক)প্রস্তুতি পর্যন্ত ছিল না । অন্যদিকে ইয়াযিদ বাহিনী তাদের মোকাবেলায় ২২ হাজার সৈন্য নিয়ে উপনীত হয় । এমনকি এই নির্দয় জালিম লোকেরা সম্মানিত আহলে বাইতেগণের জন্য ফোরাত নদীর পানি পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে দেয়।

ত্বাবারীর বর্ণনা অনুসারে ইবনে যিয়াদের নির্দেশ -

فحل بين الْحُسَيْن وأَصْحَابه وبين الماء، وَلا يذوقوا مِنْهُ قطرة، كما صنع بالتقي الزكي المظلوم أَمِير الْمُؤْمِنِينَ عُثْمَان بن عَفَّانَ

অর্থাৎ হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু , তাঁর সাথীদের মাঝে এবং ফোরাত নদীর মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াও। পানি এমনভাবে বন্ধ করে দাও, যেন এক ফোঁটাও পানি পান না করতে পারে। যেমনটি মুত্তাকী এবং নির্মলচিত্ত মজলুম আমীরুল মুমিনীন হযরত ওসমান বিন আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে করা হয়েছিল। [তারিখে ত্বাবারী ৫:৪১২]

তিন দিন যাবৎ ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর ১৮ জন আহলে বাইত ও সঙ্গীদের মধ্য হতে ৫৪ জনকে ৬১ হিজরীর ১০ই মুহররম কারবালা প্রান্তরে নির্দয় ভাবে শহীদ করা হয় । ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে অভিশপ্ত শিমার মস্তক মুবারক বিচ্ছিন্ন করে শহীদ করে ।(নাউজুবিল্লাহ)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত ,

وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ : رَأَيْتُ النَّبِيَّ  صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ  فِيمَا يَرَى النَّائِمُ ذَاتَ يَوْمٍ بِنِصْفِ النَّهَارِ ، أَشْعَثَ أَغْبَرَ ، بِيَدِهِ قَارُورَةٌ فِيهَا دَمٌ ، فَقُلْتُ : بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي ، مَا هَذَا ؟ قَالَ : ” هَذَا دَمُ الْحُسَيْنِ وَأَصْحَابِهِ ، وَلَمْ أَزَلْ أَلْتَقِطُهُ مُنْذُ الْيَوْمُ ” فَأُحْصِي ذَلِكَ الْوَقْتَ فَأَجِدُ قُتِلَ ذَلِكَ الْوَقْ

ইমাম হোসাইনের শাহাদাৎ (র:)-----2---অর্থাৎ একদিন দুপুরে আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখতে পেলাম, তাঁর পবিত্র কেশরাজি বিক্ষিপ্ত ও ধুলোবালি মিশ্রিত আর তাঁর হাত মুবারকে ছিল রক্তে পূর্ণ একটি শিশি । আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! আমার পিতা-মাতা আপনার কদম মুবারকে উৎসর্গ হোক, আপনার নুরাণী হাতে এটা কি ? তিনি ইরশাদ করলেন, এটা হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের রক্ত । আমি আজ সারা দিনই এগুলো সংগ্রহ করে যাচ্ছি । ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ঐ দিনক্ষণ হিসাব করে স্মরণে রাখলাম, পরবর্তীতে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের সংবাদ এলে মিলিয়ে দেখলাম আমার স্বপ্ন ও ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র শাহাদাত একই সময়ে সংগঠিত হয়েছে ।

হযরত সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত -

دَخَلْتُ عَلَى أُمِّ سَلَمَةَ، وَهِيَ تَبْكِي، فَقُلْتُ: مَا يُبْكِيكِ؟ قَالَتْ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تَعْنِي فِي المَنَامِ، وَعَلَى رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ التُّرَابُ، فَقُلْتُ: مَا لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: شَهِدْتُ قَتْلَ الحُسَيْنِ آنِفًا

অর্থাৎ আমি উম্মুল মুমিনীন হযরত সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার নিকট আসলাম। দেখলাম, তিনি কাঁদছেন। আমি বললাম আপনি কেন কাঁদছেন ? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলাম যে, তাঁর পবিত্র চুল ও দাঁড়ি মুবারকে মাটি লেগে আছে। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! আপনার কি হয়েছে ? তিনি ফরমালেন, আমি এইমাত্র আমার হুসাইনের শাহাদাতের ময়দান(কারবালা) থেকে আসলাম ।

ইমাম  হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মাথা মুবারক দেহ হতে আলাদা করে কুফায় ইবনে যিয়াদের নিকট রাখা করা হল । ইবনে যিয়াদ একটি ছড়ি দ্বারা ইমাম পাকের ঠোঁট মুবারকে আঘাত করা শুরু করলো। সেই মজলিশে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন প্রবীণ সাহাবী হযরত যায়েদ বিন আরকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত ছিলেন। তিনি অভিশপ্ত ইবনে যিয়াদের এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ দেখে সহ্য করতে পারলেন না । ব্যাকুল ও রাগত স্বরে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন , এই পবিত্র ঠোঁট হতে ছড়ি সরাও! আল্লাহর শপথ,নিঃসন্দেহে আমি নিজ চোঁখে বারংবার  দেখেছি যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ঠোঁট মুবারকে চুমো খেতেন । এ বলে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন । ইবনে যিয়াদ বলল, আল্লাহর শপথ ! তুমি যদি আজ বৃদ্ধ না হতে, তবে আমি তোমাকেও হত্যা করতাম ।

পবিত্র ইমাম আর অপবিত্র ইয়াযিদ

ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতে ইয়াযিদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কারো কারো বক্তব্য হল যে, এই ঘটনায় ইয়াযিদের কোন হাত ছিলনা বরং যা করার ইবনে যিয়াদই করেছে ।

নিম্নে এই বিষয়ে কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে যা দ্বারা সত্যান্বেষী ও ন্যয়পরায়ণ লোকেরা সহজেই নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে যে, এই সকল ঘটনায় ইয়াযিদের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল ।

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে জরীর ত্বাবারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি উল্লেখ করেন যে, ইয়াযিদ নিজেই ইবনে যিয়াদকে কুফার শাসনকর্তা নিয়োগ দেয় এবং নির্দেশ দেয়, হযরত মুসলিম বিন আকীল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে যেখানে পাও হত্যা কর অথবা শহর হতে বের করে দাও ।

অতঃপর যখন মুসলিম বিন আকীল ও হানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা কে শহীদ করে তাদের খণ্ডিত মস্তকদ্বয় দামেশকে ইয়াযিদের নিকট পেশ করা হয় । আর ইয়াযিদ ইবনে যিয়াদকে এ হীন কর্মের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চিঠি লিখে।

এখন জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর ইয়াযিদের প্রথম হীন কর্ম কি ছিল? আল্লামা ইবনে জরীর ত্বাবারী লিখেন যে, ইবনে যিয়াদ হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পবিত্র মস্তক তাঁর হত্যাকারীদের মাধ্যমে ইয়াযিদের নিকট প্রেরণ করে । ইয়াজিদের দরবারে পৌঁছলে মস্তক মুবারক তার সামনে রাখা হয়। ইয়াযিদ তার হাতের ছড়ি দিয়ে ইমাম পাকের ওষ্ঠ ও দাঁত মুবারকে মৃদু আঘাত করছিল আর বলছিল, তাঁর এবং আমাদের উদাহরণ এমনই, যেমন হাসীন ইবনে হামাম মুররী (তার কবিতায়) বলেছে -

يُفَلِّقْنَ هَامًا مِنْ رِجَالٍ أَعِزَّةٍ … عَلَيْنَا وَهُمْ كَانُوا أَعَقَّ وَأَظْلَمَا

অর্থাৎ তারা এমন লোকদের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছে, যারা আমাদের চাইতেও প্রভাবশালী ছিল। আর তারা ছিল অত্যাধিক অবাধ্য ও জালিম ।(নাউজুবিল্লাহ)

সেখানে সাহাবী আবু বোরযা আল আসলামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, হে ইয়াযিদ ! আল্লাহর শপথ, ছড়ি সরিয়ে নাও। তুমি যে স্থানে আঘাত করে যাচ্ছ, সেস্থানে আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু বলতে শুনেছি--

ইমাম হোসাইনের শাহাদাৎ --3--তিনি আরো বললেন, হে ইয়াযিদ মনে রেখ ! ক্বিয়ামতের দিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন উত্থিত হবেন, তখন তাঁর সুপারিশকারী হবেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তুমি যখন উত্থিত হবে এমন অবস্থায়, যখন তোমার পক্ষে সুপারিশকারী পাবে ইবনে যিয়াদকে। তখন সেই সাহাবী মজলিশ হতে উঠে চলে যান ।

এখন আপনারা নিজেরাই ফয়সালা করুন যে, ইয়াযিদের মনে কি ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র  শাহাদাতে কোন আফসোস বা দুঃখ থাকতে পারে, যে কিনা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র পবিত্র মস্তক সামনে রেখে তিরস্কার ও অহংকার করে কবিতা আবৃতি করে। যে মুবারক ঠোঁটদ্বয়ে স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা চুমু খেতেন, তাতে আঘাত করে ।এহেন কাজের কারণে সে কি লা’নত ও তিরস্কারের উপযুক্ত নয় ??

আহলে বায়তের সদস্যদের সাথে তার ( ইয়াযিদ ) দূর্ব্যবহার হতেও এ সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায় যে, যখন আহলে বায়তের শোকাহত এই কাফেলাকে অভিশপ্ত ইবনে যিয়াদ দামেশকে ইয়াযিদের নিকট প্রেরণ করল; তখন ইয়াযিদ সিরিয়ার আমীর উমরা ও রাজ কর্মচারীদের দরবারে একত্রিত করল । আর ভরা মজলিশে সকলের সামনে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের পবিত্র নারীদের আনা হল । আর ইয়াজিদের মজলিশের উপস্থিত সবাই ইয়াযিদকে তার বিজয়ের অভিনন্দন জান

ইয়াযিদ কর্তৃক আহলে বায়তের প্রতি নোংরা ও লজ্জাকর আচরণের একটি উদাহরণ-

আহলে বায়তের পবিত্র মহিলাদের যখন ইয়াযিদের দরবারে আনা হলে, এক সিরিয় দুরাচার হযরত ফাতিমা বিনতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার দিকে ইশারা করে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন(ইয়জিদ) ! এ মেয়েটি আমাকে দিন । নিস্পাপ সাইয়্যিদা ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এ কথা শুনে ভয় পেয়ে বড় বোন যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাপড় খামচে ধরলেন।

হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ঐ সিরিয়কে ভৎর্সনা করে বলে উঠলেন, বাজে বকছিস কেন কমবখত ? এ কন্যা ( শরীয়ত মতে ) তোর ভাগ্যে তো দূর স্বয়ং ইয়াযিদের ভাগ্যেও জুটবে না ।

একথা শুনে ইয়াযিদ রাগন্বিত হল এবং বলে উঠল, আল্লাহর শপথ ! সে আমার অধীনস্থ আছে। আমি যদি তাকে দিতে চাই, তাহলে দিতে পারব ।

হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রাগত স্বরে বললেন,কখনোই না। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তা’আলা তোমাকে এমনটা করার অধিকার দেননি । তবে, তুমি যদি ঘোষণা পূর্বক আমাদের ইসলাম হতে থেকে বহির্ভূত হও বা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে তাঁর গন্ডি হতে বের হয়ে যাও এবং ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ কর, তবে ভিন্ন কথা । (অর্থাৎ যতক্ষন তুমি মুসলিম পরিচয় দিবে, ততক্ষণ মুসলিম কন্যাকে গণিমত হিসেবে কবজা করতে পারবে না)

এ কথায় ইয়াযিদ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, তুমি আমার মোকাবেলা করে এ বলছ ? তোমার বাবা আর তোমার ভাই দ্বীন ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ।

হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আল্লাহর ধর্ম,আমার বাবার ধর্ম এবং আমার নানার ধর্ম ইসলাম হতেই তুমি ও তোমার বাপ-দাদা হেদায়াত পেয়েছিলে।

ইয়াযিদ বলল, তুমি মিথ্যা বলছ ।

হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তুমি জোর করে আমীর হয়ে রাজক্ষমতার দম্ভে এমন অনুচিত ও কর্কশ ভাষা আর অশোভন বাক্য প্রয়োগ করছ ।

এ কথা শুনে ইয়াযিদ চুপ হয়ে গেল । আর ঐ পাপিষ্ঠ সিরিয় আবার একই প্রশ্ন করলে, ইয়াযিদ বলে আল্লাহ তোমায় মৃত্যু দিক ।

কেউ কেউ আবার ইয়াযিদের অনুতাপ ও দুঃখ প্রকাশ করার কথা উল্লেখ করে তাকে নির্দোষ প্রমাণের প্রয়াস চালায় । তার অনুতাপ প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য আল্লামা ইবনে আসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র বক্তব্য হতেই স্পষ্ট হয়ে যায় -

“(তিনি বলেন) ইমাম পাকের মস্তক মুবারক যখন ইয়াযিদের নিকট পৌঁছল, তখন সে খুশী হয়ে গেল। তার নিকট ইবনে যিয়াদের মান মর্যাদা বেড়ে গেল । পরে যখন জানতে লাগল যে, এই ঘটনার দরুণ মানুষ তাকে ঘৃণা করছে, তার উপর অভিশাপ দিচ্ছে, গাল-মন্দ করছে তখন সে ইমাম পাকের হত্যায় অনুতপ্ত হল।

তখন সে ইবনে যিয়াদকে গালমন্দ করতে লাগল । বলতে লাগল, মারজানার পুত্রের উপর খোদার লা’নত ! হুসাইনকে হত্যা করে সে মানুষের অন্তরে আমার জন্য বিদ্বেষ ও শত্রুতার বীজ বপন করে দিয়েছে । ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সকল লোকই হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হত্যার কারণে আমায় ঘৃণা করছে। কেননা তারা মনে করছে, আমি ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করে অনেক বড় জুলুম করেছি । আল্লাহর লা’নত ও গজব ইবনে যিয়াদের উপর। সে আমায় বরবাদ করে দিল ।

ইমাম হোসাইনের শাহাদাৎ ---4--
অজ্ঞ লোকের বক্তব্য হল, ইয়াযিদের আনুগত্য গ্রহণ করা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উপর আবশ্যক ছিল । আর এই বদ ধারণা খন্ডন করে শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখছেন -

ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ইয়াযিদ কিভাবে আমীরুল মুমিনীন হতে পারে ? আর তার আনুগত্য কিভাবে মুসলমানদের উপর আবশ্যক হয় ? যেখানে কিনা ঐ সময়ে সাহাবা কেরাম এবং তাঁদের বংশধরগণ জীবিত ছিলেন এবং সকলেই তখন ইয়াজিদের আনুগত্যের ঘোষণার প্রতি অসন্তুষ্টি পোষণ করেছিলেন ।

মদীনা মুনাওয়ারা হতে কয়েকজনকে জোর করে সিরিয়ায় তার ( ইয়াযিদ ) নিকট আনা হয় । তারা ইয়াযিদের অপছন্দনীয় কাজসমূহ দেখে মদীনা ফিরে এলেন এবং বায়’আতের আহবান নাকচ করে দিলেন । ঐ লোকেরা প্রকাশ্যে বলেন যে, ইয়াযিদ আল্লাহর শত্রু, মদ্যপায়ী, নামায ত্যাগকারী, ব্যভিচারী, পাপাচারী ও মুহরিমের সাথে মিলনে বিরত হয়না ।

ইয়াযিদের পাপাচার ও ফাসেকী সম্বন্ধে শীর্ষস্থানীয় সাহাবা ও তাবেয়ীগণের বর্ণনা তারিখে ত্বাবারী, তারিখে কামিল ও তারিখুল খুলাফা তে পাওয়া যায় ।

সংক্ষেপে গসীলে মালাইকাহ ( যাকে ফিরিশতাগণ শাহাদাতের পর গোসল দেন ) হযরত হানযালা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, আল্লাহর শপথ! আমরা ইয়াযিদের আনুগত্য তখনই ছেড়ে দিয়েছি যখন আমাদের আশংকা হল যে, (তারই বদমায়েশীর কারণে) না জানি আমাদের উপর আসমান হতে পাথর বর্ষিত হয় কিনা । অবশ্যই লোকটি ( ইয়াযিদ ) মা-বোন ও কন্যাদের সাথে বিবাহে বৈধতা দেয়, প্রকাশ্যে মদ্যপান করতে থাকে এবং নামায ত্যাগ করল ।

হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন ইয়াযিদ বাহিনীর সামনে বক্তব্য দান করেন, তখনও ইয়াযিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার একই কারণ বর্ণনা করে বলেন-

“সাবধান ! নিশ্চয়ই ঐ লোকগুলো শয়তানের আনুগত্য বেছে নিয়েছে এবং দয়ালু আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করেছে। তারা দেশে অনাচার সৃষ্টি করেছে, শরীয়তের শাসনকে মুক্ত করে দিয়েছে, গণীমতের সম্পদ ব্যক্তিসম্পদের মত কুক্ষিগত করেছে । আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত বস্তুকে হালাল ও হালালকৃত বস্তুকে হারাম করে দিয়েছে।”

শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমাদের নিকট ইয়াযিদ একজন জঘন্য ঘৃণিত ব্যক্তি ছিল । এই দুরাচার যে ঘৃণ্য কাজ সমূহ আঞ্জাম দেয়, তা উম্মতের মধ্যে কোন ব্যক্তিই দিতে সক্ষম হয়নি। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত ও আহলে বায়তে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের অবমাননার পর এই দুরাচার মদীনা মুনাওয়ারায় সৈন্য প্রেরণ করে মদীনা মুনাওয়ারার অবমাননার পর মদীনাবাসীর রক্তে স্বীয় হাত রঞ্জিত করে। মদীনা পাকে অবস্থানরত বহু সাহাবী ও তাবেঈ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম তার নির্দেশে শহীদ হয় ।

মদীনা মুনাওয়ারায় ধ্বংস সাধনের পর সে মক্কা মুকাররামায় ধ্বংসলীলা সাধনের আদেশ দেয় । মক্কায় ব্যাপক হামলা হয়,হত্যা লুন্ঠন চালায়, পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ পুড়ে যায়,ছাদ পুড়ে যায়,দেয়াল ধ্বসে পড়ে। এমতাবস্থায় সে (ইয়াযিদ) মৃত্যু বরণ করে ।

আ’লা হযরত মুজাদ্দিদে দ্বীন ওয়া মিল্লাত শাহ আহমদ রজা ফাজেলে বেরেলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে লিখছেন, ইয়াযিদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের ইজমা দ্বারা অভিশপ্ত, ফাসিক, ঘৃণ্য ও কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি । এরপর তার কৃতকর্ম ও অত্যাচারের ঘটনা লিখে বলেন-

লা’নতের উপযুক্ত হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে ঘৃণ্য অভিশপ্ত কাজসমূহকে ঘৃণ্য ও পাপাচার হিসেবে না মানে । কুরআনে কারীমে এই সকল ব্যক্তিদের জন্য স্পষ্টত ‘তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত’ উল্লেখ করা হয়।

ইদানীং কিছু পথভ্রষ্ট নির্বোধ লোক বলে থাকে, “আমাদের হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইয়াজিদের মধ্যকার ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কি প্রয়োজন, তারা উভয়ই শাহজাদা।”

এরূপ মন্তব্যকারী অবশ্যই মরদুদ, খারেজী, নাসেবী ও জাহান্নামী।

ইয়াযিদ অবশ্যাই লা’নতের উপযুক্ত ছিল।

কুরআনে পাকে ইরশাদ হচ্ছে-

إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
অর্থাৎ নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেয়, তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখিরাতে।


Comments

Popular posts from this blog

গুরু শিষ্য

প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যাঁর নিকট থেকে নিজের মনের অন্ধকার দূর করে আলোকিত হওয়ার জন্য ভজন বিষয়ে যা কিছু শিক্ষা করা যায় তিনিই গুরু।                                          "গুরু গোবিন্দ দোউ খড়ে,কিনকে লাগুঁ পায়,                                           বলিহারী গুরুদেব কী,গোবিন্দ দিয়ো বাতায়।।                          বিখ্যাত এ দোহাটি দিয়ে শুরু করলাম আমার গুরুশিষ্য লেখাটির প্রথম পর্ব। গুরুর চমৎকারিত্ব তখনই, যখন তিনি গোবিন্দকে পরিচিত করিয়েছেন,তাঁকে সামনে এনে দ...

সাধকের জীবন ও কর্ম (১১-২০ পর্ব)

সাধকের জীবন ও কর্ম (পর্ব:১১) -------------------------------------------- হযরত হাসান বছরী রহ: বলেন, আমি চারটি লোকের নিকট খুবই অপ্রস্তুত হয়েছি ও কিছুু শিক্ষা অর্জন করেছি।‎তাদের একজন হিজরা,দ্বিতীয়জন মাতাল, তৃতীয়জন বালক এবং চতুর্থজন একটি মহিলা। কীভাবে তা বলছি - (ক) একদা আমি একটি হিজরা (নপুংসক) লোকের পরিহিত কাপড় ধরে আকর্ষণ করায় ‎সে বলল,জনাব! আমার গোপন রহস্য বাইরে এখনো প্রকাশ পায়নি আপনি কি তা প্রকাশ করে দিতে চান? তৎক্ষণাত প্রভূর গোপন থাকার বিষয় আমার অন্তরকে প্রভাবিত করে। (খ)একদা একটি মদখোর মাতাল অবস্থায় হেলে-দুলে পথ চলছে। আমি তাকে বললাম, পথ পিচ্ছিল কিন্তু সাবধানে পা ফেল,নইলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে জবাবে বলল,তুমি তোমার পা দুটোকো ঠিকভাবে ফেলে চলো। আমি তো মাতাল মানুষ, আছাড় খেলে কিন্তু ক্ষতি হবেনা। নিজের কাপড়ে ময়লা লাগলে তা ধুয়ে পরিষ্কার করে নেব। কিন্তু তুমি বড় এক আউলিয়া, তোমার শিষ্য - সাগরেদের অভাব নেই। তারা তোমার উপরেই ভর করে চলে। যদি চলার পথে তুমি কুপোকাত হও তবে তোমার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবারই এক অবস্থা হবে। কাজেই আমার চাইতে পথ চলার ক্ষেত্রে তোমার দ্বায়িত্ব অনেক বেশী। (গ) একদা একট...

জমি সংক্রান্ত কিছু বিষয় জেনে নিন

খতিয়ানঃ মৌজা ভিত্তিক এক বা একাধিক ভূমি মালিকের ভূ-সম্পত্তির বিবরণ সহ যে ভূমি রেকর্ড জরিপকালে প্রস্ত্তত করা হয় তাকে খতিয়ান বলে। এতে ভূমধ্যাধিকারীর নাম ও প্রজার নাম, জ...