প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যাঁর নিকট থেকে নিজের মনের অন্ধকার দূর করে আলোকিত
হওয়ার জন্য ভজন বিষয়ে যা কিছু শিক্ষা করা যায় তিনিই গুরু।
"গুরু গোবিন্দ দোউ খড়ে,কিনকে লাগুঁ পায়,
বলিহারী গুরুদেব কী,গোবিন্দ দিয়ো বাতায়।।
বিখ্যাত এ দোহাটি দিয়ে শুরু করলাম আমার গুরুশিষ্য লেখাটির প্রথম পর্ব।
গুরুর চমৎকারিত্ব তখনই, যখন তিনি গোবিন্দকে পরিচিত করিয়েছেন,তাঁকে সামনে এনে দিয়েছেন।গোবিন্দকে জানালেন না, অথচ গুরু বনে গেলেন এ এক নিছক প্রবঞ্চনা। কেবল গুরু হয়ে গেলে গুরুগিরির প্রমাণ হয়না।এজন্য একাকী উপস্থিত গুরুর কোন মহিমা নেই। মহিমা সেই গুরুরই যাঁর সঙ্গে গোবিন্দ উপস্থিত থাকেন।
" গুরু গোবিন্দ দোউ খড়ে" অর্থাৎ যিনি প্রভুকে পাইয়ে দিয়েছেন তিনিই প্রকৃত গুরু।
প্রকৃত গুরু তিনি যাঁর হৃদয়ে শিষ্যের কল্যানের ইচ্ছে থাকে এবং প্রকৃত শিষ্য সেই, গুরুর প্রতি যার ভক্তি থাকে। যদি পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা সোনা না হয়ে যায় তাহলে তা আসল পরশ পাথর নয় অথবা লোহা ঠিক লোহা নয়।
কচ্ছপ বালির মধ্যে ডিম পাড়ে কিন্তু নিজে জলের মধ্যে থেকেও সেই ডিমকে মনে রাখে ;আর তার সেই স্মরণের ফলেই ডিম ফোটে।সেই রকম গুরুকে স্মরণ করা মাত্রই শিষ্যের জ্ঞান প্রাপ্তি হয়। এটা হল স্মরণ দীক্ষা।
দৃষ্টি দীক্ষা :- মাছ যেমন জলের মধ্যে নিজের ডিমের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে থাকে, তার তাকানোর ফলে যেমন ডিম ফোটে ঠিক তেমনই গুরুর কৃপাদৃষ্টিতে শিষ্য জ্ঞান লাভ করে।
শব্দদীক্ষা :-উদাহরণ হিসেবে তিতির পাখির কথা বলা যেতে পারে। পাখি ডিম পাড়ে জমিনে কিন্তু আকাশে শব্দ করতে করতে চক্কর দিতে থাকে। তার শব্দের ফলেই ডিম ফোটে। তেমনি গুরু তার কথা দ্বারা শিষ্যকে জ্ঞান দান করেন। শিষ্য যত দূরেই থাকুক।
ময়ুরী তার ডিমের উপর বসে থাকে তার স্পর্শে ডিম ফোটে। গুরুর হাতের স্পর্শ দ্বারাও শিষ্যের জ্ঞান লাভ হয়ে থাকে আর এটাই স্পর্শ দীক্ষা।
যদি কামেল গুরু না হন তবে কোন দীক্ষাই কাজে লাগবেনা। আজকালতো গুরুর অভাব নেই নিজে তত্ত্ব জানেনা শিষ্যকে কী শেখাবে। মূলত মাকাল ফল হিসেবে বসে আছে। এরুপ এক নকল গুরু কালসেমী রাক্ষস কে হনুমান ল্যাজে জড়িয়ে আছাড় মেরেছিল (লঙ্কা কান্ড ৫৭/৪)
শ্রীকর পাত্রজী মহারাজ বলতেন "যে গুরু কাউকে শিষ্য করে নেন কিন্তু তার উদ্ধার করেন না তিনি পরের জন্মে কুকুর হন আর শিষ্য পোকা হয়ে তাঁর রক্ত শোষণ করে।
মানুষের জন্ম দুই রকমের হয়ে থাকে। একটি ব্যাবহারিক অপরটি পারমার্থিক। পিতামাতার শুক্রযোনিতে যে জন্ম তা ব্যাবহারিক জন্ম। আর মন্ত্রদীক্ষা হতে যে জন্ম তা হল পারমার্থিক জন্ম।দুটার সম্বন্ধ দুই রকমই। বাবা,দাদা ক্রমে বংশের আদি পুরুষের যে সম্পর্ক তা ব্যাবহারিক। আর গুরু-পরমগুরু ক্রমে স্বীয় সম্প্রদায়ের আদি গুরুর সাথে যে সম্পর্ক যুক্ত এটাকে পারমার্থিক বা ভগবত জন্ম বলা হয়ে থাকে। শুক্র জন্মে মানুষের প্রথম জন্ম তারপর দীক্ষা গ্রহণ করলেই ভগবত জন্ম হয়।ভগবত জন্ম দ্বারাই গুরু পরম্পরাক্রমে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের জন্ম হয়।
স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে যে,"অদীক্ষিত ব্যাক্তির কৃত সমস্ত কর্মই নিরর্থক (নিস্ফল)হয়।দীক্ষাহীন ব্যাক্তি পরজনমে পশুযোনী প্রাপ্ত হয়ে থাকে"
তাই তত্ত্ব জ্ঞান লাভের জন্য গুরুর স্মরণ গ্রহণ করতে হবে। এবং শিষ্যকে শ্রুতিবাক্য মেনে চলতে হবে। তবেই গুরু শিষ্যের সম্পর্ক অটুট থাকবে।
শাস্ত্রে গুরুর যোগ্যতার কথা যেমন বলা আছে তেমনি শিষ্যের যোগ্যতার কথাও তেমনি বলা হয়েছে। যেমন-যারা অলস,মলিন,দাম্ভিক,কৃপণ,রাগী,বিষয়াসক্ত,
ভোগলোলুপ,অন্যায়রুপে উপার্জনকারী,পরদারপরায়ন,
অজ্ঞ, পন্ডিতমন্য,পাপীষ্ঠ,উপদেশ সহ্য করতে অক্ষম অর্থাৎ চিত্ত্বগত দোষ গুলি যার আছে এদেরকে ভক্তিবিলাস শাস্ত্রে শিষ্যত্ব গ্রহণে নিষেধ আছে।
পীর ফার্সি শব্দের প্রতিশব্দ পবিত্র কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শব্দে প্রকাশ করেছেন, যথাঃ 'অলি' বহুবচনে আউলিয়া, মুর্শিদ, ইমাম, বহুবচনে আইম্মা, হাদি, ছিদ্দিকিন, ইত্যাদি ।বাংলা ভাষায় আমরা পীর কে গুরু বলে ডাকলে কোন হেরফের হওয়ারও সম্ভাবনা নেই কারন যিনি আমার আপনার পীর হবেন উনিই হলেন গুরু। “মুরীদ” শব্দটিও আরবী। যার অর্থ হল ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন বুযুর্গ ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করে, সে ব্যক্তির নাম হল “মুরীদ”।
ইসলাম কি বলে দেখি গুরু/পীর/মূর্শিদ/ইমাম ধরা সম্পর্কে।
নিম্নে কিছু আয়াত শরিফের অর্থ পেশ করা হলঃ
হে মুমিনগণ! তোমরা অনুসরণ কর, আল্লাহ্ পাক এর, তাঁর রাসুল পাক (দঃ) এর এবং তোমাদের মধ্যে যারা ধর্মীয় নেতা ।
— সুরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৫৯
স্মরণ কর! সেই দিনকে যেদিন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাঁদের (ইমাম) নেতা সহ আহ্বান করব ।
— বনি ইসরাইল, আয়াতঃ ৭১
মুমিন পুরুষ ও মুমিনা মেয়েলোকের ভিতর হতে কতেক কতেকের বন্ধু ।
— সুরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৭১
তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে ।
— সুরাঃ আল-ইমরান, আয়াতঃ ৭১
অনুসরন কর তাঁদের যারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাহে না, এবং যারা সৎ পথ প্রাপ্ত ।
— সুরাঃ ইয়াসিন, আয়াতঃ ২১
যে বিশুদ্ধ চিত্তে আমার অভিমুখি হয়েছে তাঁর পথ অনুস্মরণ কর
— সুরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ১৫
জিকির সম্বন্ধে তোমাদের জানা না থাকলে জিনি জানেন তাঁর নিকট হতে জেনে নাও ।
— সুরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৭
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (ছাদেকিন) সত্যবাদী গণের সঙ্গী হয়ে যাও ।
— সুরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১১৯
নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাকের রহমত (মুহসিনিন) আউলিয়া কিরামগনের নিকটবর্তী ।
— সুরাঃ আরাফ, আয়াতঃ ৫৬
আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত হয় এবং তিনি (আল্লাহ্) যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনো তাঁর জন্য কোন পথপ্রদর্শনকারী (মুরশিদ) পাবে না ।
— সুরাঃ কাহাফ, আয়াতঃ ১৭
সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নেই, এবং তারা কোন বিষয় এ চিন্তিতও নহে । তাঁদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর কথার কোন পরিবর্তন হয় না, উহাই মহা সাফল্য ।
— সুরাঃ ইউনুছ, আয়াতঃ ৬২-৬৪
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় কর, এবং তাকে পাবার জন্য (নৈকট্য লাভের) অছিলা তালাশ কর ।
— সুরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ৩৫
এবার হাদিস শরীফ থেকে কিছুই উদ্ধৃতি দিচ্ছি :-
রাসূলে কারীম (সাঃ) একাধিক স্থানে নেককার ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন-
عن أبي موسى رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( مثل الجليس الصالح والسوء كحامل المسك ونافخ الكير فحامل المسك إما أن يحذيك وإما أن تبتاع منه وإما أن تجد منه ريحا طيبة ونافخ الكير إما أن يحرق ثيابك وإما أن تجد ريحا خبيثة )
অনুবাদ-হযরত আবু মুসা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-সৎসঙ্গ আর অসৎ সঙ্গের উদাহরণ হচ্ছে মেশক বহনকারী আর আগুনের পাত্রে ফুঁকদানকারীর মত। মেশক বহনকারী হয় তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তুমি নিজে কিছু খরীদ করবে। আর যে ব্যক্তি আগুনের পাত্রে ফুঁক দেয় সে হয়তো তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দিবে, অথবা ধোঁয়ার গন্ধ ছাড়া তুমি আর কিছুই পাবে না। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫২১৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৮৬০, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৩১৯০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৮৩১, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬১, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৪২৯৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৬৬০, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৭৭০, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২৬২২, মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস নং-১৩৭৭, মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-৫১৫}
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন শিক্ষা করছ, তাকে দেখে নাও”। (মুসলিম শরীফ)
সহিহ হাদীসে আছে :-
عَنْ اِبْنِ عُمَرَ (رض) عَنِ النَّبِيْ (صلعم) قَالَ مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِيْ عُنُقِه بَيْعَ’ُ مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيْةً ـ (مسلم )
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) রাসূলে পাক (সা) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেল সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। (মুসলিম)
★ অপর হাদিসে আছে :-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنْ دِيْنَارٍ (رض) اَنَّهُ سًمِعَ اللهِ بْنْ عُمَرَ (رض) يُقَوْلُ كُنَّا نَبَايِعْ رَسُوْلُ اللهِ (صلعم) عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ يَقًُوْلُ لََنَا فِيْهَا اِسْتَطَيْعْتُمْ ـ (مسلم)
★ আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার (রা) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) কে বলতে শুনেছেন যে, আমরা রাসূল (দ:) এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতাম, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপর এবং তিনি আমাদের সামর্থ্য উক্ত আমল করার অনুমতি দিয়েছেন। (মুসলিম)
শরীয়তে অসংখ্য দলীল আছে পীর-মুরিদী সম্পর্ক।সাহাবারা আকাবার শপথ করে নবীপাকের মুরীদ হয়েছেন,ইজমা কিয়াসের আলেমরা পূর্বসূরিদের কাছে মুরীদ হয়েছেন, বড়পীর মুরীদ হয়েছেন, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী সানজেরী মুরিদ ছিলেন ওসমান হারুনীর কাছে,রুমি মুরীদ হয়েছেন শামসে তেব্রিজের কাছে যুগে যুগে অসংখ্য আউলিয়া কেরাম নিজেরা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন কামেল গুরুর নিকট।
তাফসিরে কবীর এর রচয়িতা বিশ্বখ্যাত মোফাসসিরে কোরআন আল্লামা হযরত ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর মৃত্যু শয্যায় শয়তানের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। ফখরুদ্দীন রাজী মৃত্যু শয্যায় শয়তানের বেড়াজালে পড়লেন! তখন নিজের যোগ্যতায় তিন’শ ষাটটি দলিল উপস্থাপন করলো যে, লা-শারিক, আল্লাহ এক’। তবুও শয়তানের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না, তখনই তাঁর যোগ্যতা-সম্পন্ন পীর-মুর্শিদ হযরত শাইখ নাজিমুদ্দীন কোবরা (রহ.) প্রায় তিন’শ মাইল দূর থেকে রুহানিভাবে দেখতে পেলেন, তাঁর ভক্ত-মুরিদ ফখরুদ্দীন রাজী মৃত্যু শয্যায় শয়তানের ধোকায় পড়তে যাচ্ছে। তখন তিনি অজুর পানির ঘটি নিক্ষেপ করলেন, পানিসহ ঘটি এসে ফখরুদ্দীন রাজীর গায়ে পড়লো। ঘটির ভিতর থেকে আওয়াজ আসল, হে ফখরুদ্দীন রাজী, তুমি শয়তানকে বলো, বিনা দলিলে আমার প্রভু এক’ এবং বিশ্বাস করি তিনি অবিনশ্বর।’ ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (রহ.)-এ কথা শয়তানকে বললে, শয়তান পরাজিত হয়ে বললো --" হে ফখরুদ্দীন রাজী, যদি আজ তোমার কোন কামেল পীর-মুর্শিদ না থাকতো তাহলে তুমি কিছুতেই ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারতে না।" এভাবেই শয়তানের কবল থেকে ফখরুদ্দীন রাজীর ঈমান রক্ষা পেল। এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, মুরিদ যতই যোগ্যতা-সম্পন্ন, কেতাবি আলেম হোক না কেনো। যোগ্য পীরের সান্নিধ্য না পেলে তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা অনেক সময়ই বেকার প্রমাণিত হয়।
গুরু শিষ্যের পঞ্চম পর্বে আজ আলোচনা করব ভক্তি ও ভক্তের করণীয় সম্পর্কে :- পূজনীয় দেবতা বা ব্যক্তির প্রতি বিশেষ অনুরাগ বা প্রেমকেই ভক্তি বলা হয়।ঈশ্বরের নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের নামই ভক্তি।ভক্তির পথে যিনি ঈশ্বরোপাসনা করেন, তাঁকে ভক্ত নামে এবং ভক্তিবাদী দর্শনকে ভক্তিমার্গ নামে অভিহিত করা হয়। ভক্তিবাদ হিন্দুধর্মের একাধিক শাখাসম্প্রদায়ের মূলভিত্তি। বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভক্তিবাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে।
ইসলাম বলে মুরীদ যার অর্থ ইচ্ছাপোষণকারী অর্থাৎ পীর বা গুরুর প্রতিটি আদেশ পালনে ইচ্ছাপোষণ করাই হচ্ছে শিষ্যের কাজ।
মকতুবাতে আছে --
১)গুরু উপস্থিত থাকা অবস্থায় স্বীয় পীর ব্যাতীত অন্য কারো প্রতি লক্ষ্য করবেনা।
২)পীর উপস্থিত থাকা অবস্থায় তার অনুমতি ব্যাতীত নফল এবাদত ও জিকির আজকারে লিপ্ত হবেনা।
৩)পীরের জায়নামাজের উপর কখনো পা রাখবেনা বা দাড়াঁবেনা। পীরের সামনে কারও সাথে কথাবার্তা বলবেনা;কারও প্রতি লক্ষ্য পর্যন্ত করবে না।
৪)পীরের সামনে তাঁর বিনা অনুমতিতে পানাহার করবে না।
৫)গুরুর দিকে পা প্রসারিত করে বসবে না। সেদিকে কফ,থুতু ইত্যাদি নিক্ষেপ করবে না।
৬)পীর যে কাজ করেন না বুঝে নির্দিধায় মেনে নিতে হবে।
৭)তাকে দেখেই কর্ম শিখতে হবে যেভাবে বলবে ঠিক সেভাবে।
৮)গুরুর দোষত্রুটি অনুসন্ধান করবেনা।
৯)নিজের অলৌকিক ক্ষমতা থাকলেও গুরুর সামনে প্রদর্শণ করবেনা।
১০)যদি তার কোন বিষয়ে মনে সন্দেহ জাগে সরাসরি জিঙ্গাসা করবে।
১১)নিজের কর্মের উপর কখনও নির্ভর করবেনা।
১২)পীরের আদেশ ব্যাতীত তার নিকট হতে অন্যত্র যাবেনা।
১৩)পীরের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবেনা। এবং বাজে কথা বলা উচিত নয়।
১৪)মুরীদের জন্য পীরের খেদমত এবং গুরু ভাইদের প্রতি সদাচরণ প্রদর্শন করা অবশ্য কর্তব্য।
আবু ইসহাক ইব্রাহীম রহ: সাযরোনের কুতুব ছিলেন তিনি তাঁর মুরীদগণকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা কখনও মেহমান ছাড়া আহার করবেনা। কিন্তু এক মুরীদ বন্ধুর দাওয়াত রক্ষা করতে দাওয়াত গ্রহণ করল যেখানে কোন মেহমান ছিলনা। একাই খেয়ে আসল। দুদিন পর এক ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হলে মুরীদকে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিল। গুরুর কাছে খবর আসা মাত্র গুরু বললেন মেহমান ছাড়া খেলে যা হয় বলেছিলাম।
গুরুর আদেশ অমান্য করলে কয়েকটি বিপদ উপস্থিত হয় ১)দূর্ঘটনার শিকার হবে ২) হতাশাগ্রস্থ হয়ে জীবন কাটবে ৩) বিপদাপদ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
শাস্ত্রে আছে -যিনি মন্ত্র,তিনিই গুরু,যিনি গুরু তিনিই স্বয়ং হরি। হরি রুষ্ট হলে গুরুদেব রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু গুরু রুষ্ট হলে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন --গুর সেবা দ্বারা আমি যত তুষ্টি লাভ করি, পূজা,বৈষ্ণবদীক্ষা, সমাধি বা ভগবানে নিষ্ঠা দ্বারাও আমি তত তুষ্টি লাভ করিনা।
সেদিন প্রচন্ড গরম তাছাউফ শিক্ষাকেন্দ্রে বসে আমার গুরুজী সবাইকে দীক্ষা দিচ্ছেন। আমার শহরে জন্ম, বসবাস করার কারনে এবং বাবার আদরের দুলাল বলে নিজের হাত পাখার ব্যাবহার তেমন একটা করতে হয়নি। কিন্তু সেদিন বিদ্যুত নেই গুরুকে আমি বাতাস করছিলাম (যদিও গুরু আমাকে বাতাস করতে বলেন নি) । তো এক পর্যায়ে গুরুজী উনার গুরু খাজা ছায়েদ হোসেন চিশতী নিজামী (রহ:) কথা বলছেন যে,গুরুজী যখন তাঁর গুরুকে বাতাস করতেন তখন সবাই ঘামতেন কিন্তু তিনি ঘামতেন না। যখনই এ কথা বললেন অবাক ও তাজ্জবের কান্ড চারপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই ঘামছে কিন্তু আমি একটুও ঘামাইনি। সুবহানাল্লাহ।
কিন্তু হাত পাখাতে বাতাস করার কারণে এবং আমার অভ্যেস না থাকার কারণে আমার হাতে একটা ছোট ফুসকা পড়ে। বুঝতে পারছি পরীক্ষা চলছে। গুরুকে আর বলিনি ফুসকা পড়েছে পাশের আরেকজন দেখছে সে সময় ফুসকা কিন্তু গুরুকে বলিনি। কি বলব সেই কথা সুবহানাল্লাহ কিছুক্ষণ পড় দেখি ফুসকা নেই জ্বালাপোড়াও নেই।
তাই সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে যাদের গুরু আছে তারা গুরু নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে পালন করার চেষ্টা করবেন তবেই গুরু আপনার দিকে খেয়াল করবেন। মনের রাখবেন ভক্তের হৃদয়ের খবর গুরু জানেন।
জালালুদ্দীন রুমীকে তার পীর মদ নিয়ে আসতে বলেছিল প্রকাশ্যে পরীক্ষা করার জন্য এবং উনি পাশ করেছেন।
ঐ সময় রুমী মস্তবড় শরীয়তের মাওলানা ছিলেন। শামসেতেব্রিজ একদিন বললেন -যাওতো দেখি বাজার থেকে মদ/সুরা নিয়ে আসো। রুমী অবাক প্রশ্ন না করেই দৌড়ে চলে গেলেন মদের দোকানে। চুপটি করে জুব্বার নীচে লুকিয়ে নিয়ে এলেন মদ গুরুর কাছে আসার পর গুরু বলল কোথায় মদ তখন জুব্বার নীচ থেকে বের করলেন। তেব্রিজ রহ: বললেন এ মদ আমি ছুঁইবোনা কারন তুমি এটা লুকিয়ে এনেছ। আবার দৌঁড়ে গেলেন এবার মদ কিনে মাথায় করে নিয়ে আসছেন চারপাশে সবাই বলছে রুমী গিয়েছে বাতিল হয়ে ওর পীরও গেছে বাতিল হয়ে। মাথায় ছিল তাই সামনে এসেও মাথা থেকে নামায়নি।
গুরু রুমী কে বলল কি নিয়ে আসছ?
রুমী বলল মদ।
গুরু বলল দাও দেখি।
রুমী মাথা থেকে নামিয়ে দেখল মদ আর মদ নেই তা দুধে পরিপূর্ণ।
তেব্রিজ বলল তুমি পরীক্ষায় উত্তির্ণ হলে কারণ তোমার ভেতরে যে অহংকার ছিল যে তুমি এ শহরের মস্তবড় আলেম। তা আজ ভেঙ্গে চূর্ণ হয়েছে।
গুরু ধরলেই কল্যাণ হয়না, গুরুর কথা মানলেই কল্যাণ হয়।তার কারন গুরু হলেন শব্দ,শরীর নন।শরীরও গুরু নয়।তাই গুরুর কখনও মৃত্যু হয়না। যদি গুরু মারা যান তাহলে শিষ্যের কল্যাণ হবে কী করে? যদি কোন হাড় মাংসযুক্ত শরীর গুরু হয় তাহলে সে অধম গুরুর বেশে কালনেমী রাক্ষস।
প্রভুর কাছ থেকে লাভবান হওয়ার পাঁচটি উপায় আছে ---নামজপ,ধ্যান,সেবা,আজ্ঞা পালন এবং সঙ্গ। কিন্তু সাধু মহাত্মদের কাছ থেকে লাভবান হওয়ার তিনটি উপায়ই উপযুক্ত--- সেবা,আজ্ঞাপালন, সঙ্গ। তাই গুরুর নামযপ না করে তাঁর আজ্ঞা নির্দেশ পালন করা উচিত।গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করাই প্রকৃতপক্ষে গুরু সেবা।গুরু শরীর নন মূলত তিনি হলেন তত্ত্ব।
অনেকেই দেখা যায় গুরু তাঁর ফটো দেন গলায় পড়তে দেন,তার পূজা এবং ধ্যান করান-তিনি প্রতারণা করেন। ভগবানের চিন্ময় পবিত্র শরীর। হাড় মাংসের শরীর নয়।
গুরুতো তিনিই যিনি শিষ্যকে প্রভুর সামনা সামনি করে দেন। প্রভুর প্রতি বিশ্বাস জাগ্রত করেন। হনুমান বিভীষনের বিশ্বাসকে নিজের দিকে আকৃষ্ট না করে ভগবানের দিকে করেছিলেন।
একটি ঘটনা বলি---৫৫ বছর জল্লাদগিরি করে একজন জল্লাদ অবসরে যাওয়ার দিন ভালো এক পোশাক পড়ে তার প্রিয় খাদ্য প্রস্তুত করে খাওয়া শুরু করতে যাচ্ছিল তখনই সারিপুত্র ভন্তে ধ্যান থেকে উঠে তার দরজায় এসে দাঁড়ালেন ভিক্ষার জন্য?
জল্লাদ তাকে নিজের খাদ্য দান করল।ভন্তে তাকে ধর্মবাণী শোনাচ্ছিল কিন্তু তার মনযোগ সেই হত্যাকারী মানুষগুলোর স্মৃতিতে। যদিও হকুম দিয়েছিল রাজা।
ভন্তে ধর্মদেশনা দিতে লাগলেন ভক্তি সহকারে শুনতে শুনতে বিদর্শণ জ্ঞানলাভে সক্ষম হলো অনেকটা নির্বানের প্রথম স্তরে পড়ে যাওয়ার মত। এর পর যখন সারিপুত্র ভন্তকে বিদায় দিয়ে আসছিল পথে গাভীর শিংয়ের গুতা খেয়ে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর ভিক্ষুরা জানতে চাইল সেই জল্লাদ কোথায় জন্মেছে? বুদ্ধ বলল তার শেষ সময়ে বিদর্শণ জ্ঞানলাভের কারনে তুষিত স্বর্গে জন্ম নিয়েছে।
অতএব ভক্তিতেই মুক্তি। দেশনা গুরুর প্রতিই দেয়া হয়ে থাকে। গুরু ধরলেই কল্যাণ হবেনা যদিনা এমন কর্ম থাকে।
"গুরু গোবিন্দ দোউ খড়ে,কিনকে লাগুঁ পায়,
বলিহারী গুরুদেব কী,গোবিন্দ দিয়ো বাতায়।।
বিখ্যাত এ দোহাটি দিয়ে শুরু করলাম আমার গুরুশিষ্য লেখাটির প্রথম পর্ব।
গুরুর চমৎকারিত্ব তখনই, যখন তিনি গোবিন্দকে পরিচিত করিয়েছেন,তাঁকে সামনে এনে দিয়েছেন।গোবিন্দকে জানালেন না, অথচ গুরু বনে গেলেন এ এক নিছক প্রবঞ্চনা। কেবল গুরু হয়ে গেলে গুরুগিরির প্রমাণ হয়না।এজন্য একাকী উপস্থিত গুরুর কোন মহিমা নেই। মহিমা সেই গুরুরই যাঁর সঙ্গে গোবিন্দ উপস্থিত থাকেন।
" গুরু গোবিন্দ দোউ খড়ে" অর্থাৎ যিনি প্রভুকে পাইয়ে দিয়েছেন তিনিই প্রকৃত গুরু।
প্রকৃত গুরু তিনি যাঁর হৃদয়ে শিষ্যের কল্যানের ইচ্ছে থাকে এবং প্রকৃত শিষ্য সেই, গুরুর প্রতি যার ভক্তি থাকে। যদি পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা সোনা না হয়ে যায় তাহলে তা আসল পরশ পাথর নয় অথবা লোহা ঠিক লোহা নয়।
কচ্ছপ বালির মধ্যে ডিম পাড়ে কিন্তু নিজে জলের মধ্যে থেকেও সেই ডিমকে মনে রাখে ;আর তার সেই স্মরণের ফলেই ডিম ফোটে।সেই রকম গুরুকে স্মরণ করা মাত্রই শিষ্যের জ্ঞান প্রাপ্তি হয়। এটা হল স্মরণ দীক্ষা।
দৃষ্টি দীক্ষা :- মাছ যেমন জলের মধ্যে নিজের ডিমের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে থাকে, তার তাকানোর ফলে যেমন ডিম ফোটে ঠিক তেমনই গুরুর কৃপাদৃষ্টিতে শিষ্য জ্ঞান লাভ করে।
শব্দদীক্ষা :-উদাহরণ হিসেবে তিতির পাখির কথা বলা যেতে পারে। পাখি ডিম পাড়ে জমিনে কিন্তু আকাশে শব্দ করতে করতে চক্কর দিতে থাকে। তার শব্দের ফলেই ডিম ফোটে। তেমনি গুরু তার কথা দ্বারা শিষ্যকে জ্ঞান দান করেন। শিষ্য যত দূরেই থাকুক।
ময়ুরী তার ডিমের উপর বসে থাকে তার স্পর্শে ডিম ফোটে। গুরুর হাতের স্পর্শ দ্বারাও শিষ্যের জ্ঞান লাভ হয়ে থাকে আর এটাই স্পর্শ দীক্ষা।
যদি কামেল গুরু না হন তবে কোন দীক্ষাই কাজে লাগবেনা। আজকালতো গুরুর অভাব নেই নিজে তত্ত্ব জানেনা শিষ্যকে কী শেখাবে। মূলত মাকাল ফল হিসেবে বসে আছে। এরুপ এক নকল গুরু কালসেমী রাক্ষস কে হনুমান ল্যাজে জড়িয়ে আছাড় মেরেছিল (লঙ্কা কান্ড ৫৭/৪)
শ্রীকর পাত্রজী মহারাজ বলতেন "যে গুরু কাউকে শিষ্য করে নেন কিন্তু তার উদ্ধার করেন না তিনি পরের জন্মে কুকুর হন আর শিষ্য পোকা হয়ে তাঁর রক্ত শোষণ করে।
মানুষের জন্ম দুই রকমের হয়ে থাকে। একটি ব্যাবহারিক অপরটি পারমার্থিক। পিতামাতার শুক্রযোনিতে যে জন্ম তা ব্যাবহারিক জন্ম। আর মন্ত্রদীক্ষা হতে যে জন্ম তা হল পারমার্থিক জন্ম।দুটার সম্বন্ধ দুই রকমই। বাবা,দাদা ক্রমে বংশের আদি পুরুষের যে সম্পর্ক তা ব্যাবহারিক। আর গুরু-পরমগুরু ক্রমে স্বীয় সম্প্রদায়ের আদি গুরুর সাথে যে সম্পর্ক যুক্ত এটাকে পারমার্থিক বা ভগবত জন্ম বলা হয়ে থাকে। শুক্র জন্মে মানুষের প্রথম জন্ম তারপর দীক্ষা গ্রহণ করলেই ভগবত জন্ম হয়।ভগবত জন্ম দ্বারাই গুরু পরম্পরাক্রমে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের জন্ম হয়।
স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে যে,"অদীক্ষিত ব্যাক্তির কৃত সমস্ত কর্মই নিরর্থক (নিস্ফল)হয়।দীক্ষাহীন ব্যাক্তি পরজনমে পশুযোনী প্রাপ্ত হয়ে থাকে"
তাই তত্ত্ব জ্ঞান লাভের জন্য গুরুর স্মরণ গ্রহণ করতে হবে। এবং শিষ্যকে শ্রুতিবাক্য মেনে চলতে হবে। তবেই গুরু শিষ্যের সম্পর্ক অটুট থাকবে।
শাস্ত্রে গুরুর যোগ্যতার কথা যেমন বলা আছে তেমনি শিষ্যের যোগ্যতার কথাও তেমনি বলা হয়েছে। যেমন-যারা অলস,মলিন,দাম্ভিক,কৃপণ,রাগী,বিষয়াসক্ত,
ভোগলোলুপ,অন্যায়রুপে উপার্জনকারী,পরদারপরায়ন,
অজ্ঞ, পন্ডিতমন্য,পাপীষ্ঠ,উপদেশ সহ্য করতে অক্ষম অর্থাৎ চিত্ত্বগত দোষ গুলি যার আছে এদেরকে ভক্তিবিলাস শাস্ত্রে শিষ্যত্ব গ্রহণে নিষেধ আছে।
পীর ফার্সি শব্দের প্রতিশব্দ পবিত্র কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শব্দে প্রকাশ করেছেন, যথাঃ 'অলি' বহুবচনে আউলিয়া, মুর্শিদ, ইমাম, বহুবচনে আইম্মা, হাদি, ছিদ্দিকিন, ইত্যাদি ।বাংলা ভাষায় আমরা পীর কে গুরু বলে ডাকলে কোন হেরফের হওয়ারও সম্ভাবনা নেই কারন যিনি আমার আপনার পীর হবেন উনিই হলেন গুরু। “মুরীদ” শব্দটিও আরবী। যার অর্থ হল ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন বুযুর্গ ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করে, সে ব্যক্তির নাম হল “মুরীদ”।
ইসলাম কি বলে দেখি গুরু/পীর/মূর্শিদ/ইমাম ধরা সম্পর্কে।
নিম্নে কিছু আয়াত শরিফের অর্থ পেশ করা হলঃ
হে মুমিনগণ! তোমরা অনুসরণ কর, আল্লাহ্ পাক এর, তাঁর রাসুল পাক (দঃ) এর এবং তোমাদের মধ্যে যারা ধর্মীয় নেতা ।
— সুরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৫৯
স্মরণ কর! সেই দিনকে যেদিন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাঁদের (ইমাম) নেতা সহ আহ্বান করব ।
— বনি ইসরাইল, আয়াতঃ ৭১
মুমিন পুরুষ ও মুমিনা মেয়েলোকের ভিতর হতে কতেক কতেকের বন্ধু ।
— সুরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৭১
তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে ।
— সুরাঃ আল-ইমরান, আয়াতঃ ৭১
অনুসরন কর তাঁদের যারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাহে না, এবং যারা সৎ পথ প্রাপ্ত ।
— সুরাঃ ইয়াসিন, আয়াতঃ ২১
যে বিশুদ্ধ চিত্তে আমার অভিমুখি হয়েছে তাঁর পথ অনুস্মরণ কর
— সুরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ১৫
জিকির সম্বন্ধে তোমাদের জানা না থাকলে জিনি জানেন তাঁর নিকট হতে জেনে নাও ।
— সুরাঃ আম্বিয়া, আয়াতঃ ৭
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (ছাদেকিন) সত্যবাদী গণের সঙ্গী হয়ে যাও ।
— সুরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১১৯
নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাকের রহমত (মুহসিনিন) আউলিয়া কিরামগনের নিকটবর্তী ।
— সুরাঃ আরাফ, আয়াতঃ ৫৬
আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত হয় এবং তিনি (আল্লাহ্) যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনো তাঁর জন্য কোন পথপ্রদর্শনকারী (মুরশিদ) পাবে না ।
— সুরাঃ কাহাফ, আয়াতঃ ১৭
সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নেই, এবং তারা কোন বিষয় এ চিন্তিতও নহে । তাঁদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর কথার কোন পরিবর্তন হয় না, উহাই মহা সাফল্য ।
— সুরাঃ ইউনুছ, আয়াতঃ ৬২-৬৪
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ পাককে ভয় কর, এবং তাকে পাবার জন্য (নৈকট্য লাভের) অছিলা তালাশ কর ।
— সুরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ৩৫
এবার হাদিস শরীফ থেকে কিছুই উদ্ধৃতি দিচ্ছি :-
রাসূলে কারীম (সাঃ) একাধিক স্থানে নেককার ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন-
عن أبي موسى رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( مثل الجليس الصالح والسوء كحامل المسك ونافخ الكير فحامل المسك إما أن يحذيك وإما أن تبتاع منه وإما أن تجد منه ريحا طيبة ونافخ الكير إما أن يحرق ثيابك وإما أن تجد ريحا خبيثة )
অনুবাদ-হযরত আবু মুসা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-সৎসঙ্গ আর অসৎ সঙ্গের উদাহরণ হচ্ছে মেশক বহনকারী আর আগুনের পাত্রে ফুঁকদানকারীর মত। মেশক বহনকারী হয় তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তুমি নিজে কিছু খরীদ করবে। আর যে ব্যক্তি আগুনের পাত্রে ফুঁক দেয় সে হয়তো তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দিবে, অথবা ধোঁয়ার গন্ধ ছাড়া তুমি আর কিছুই পাবে না। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫২১৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৮৬০, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৩১৯০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৮৩১, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬১, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৪২৯৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৬৬০, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৭৭০, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২৬২২, মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস নং-১৩৭৭, মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-৫১৫}
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন শিক্ষা করছ, তাকে দেখে নাও”। (মুসলিম শরীফ)
সহিহ হাদীসে আছে :-
عَنْ اِبْنِ عُمَرَ (رض) عَنِ النَّبِيْ (صلعم) قَالَ مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِيْ عُنُقِه بَيْعَ’ُ مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيْةً ـ (مسلم )
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) রাসূলে পাক (সা) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেল সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। (মুসলিম)
★ অপর হাদিসে আছে :-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنْ دِيْنَارٍ (رض) اَنَّهُ سًمِعَ اللهِ بْنْ عُمَرَ (رض) يُقَوْلُ كُنَّا نَبَايِعْ رَسُوْلُ اللهِ (صلعم) عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ يَقًُوْلُ لََنَا فِيْهَا اِسْتَطَيْعْتُمْ ـ (مسلم)
★ আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার (রা) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) কে বলতে শুনেছেন যে, আমরা রাসূল (দ:) এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতাম, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপর এবং তিনি আমাদের সামর্থ্য উক্ত আমল করার অনুমতি দিয়েছেন। (মুসলিম)
শরীয়তে অসংখ্য দলীল আছে পীর-মুরিদী সম্পর্ক।সাহাবারা আকাবার শপথ করে নবীপাকের মুরীদ হয়েছেন,ইজমা কিয়াসের আলেমরা পূর্বসূরিদের কাছে মুরীদ হয়েছেন, বড়পীর মুরীদ হয়েছেন, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী সানজেরী মুরিদ ছিলেন ওসমান হারুনীর কাছে,রুমি মুরীদ হয়েছেন শামসে তেব্রিজের কাছে যুগে যুগে অসংখ্য আউলিয়া কেরাম নিজেরা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন কামেল গুরুর নিকট।
তাফসিরে কবীর এর রচয়িতা বিশ্বখ্যাত মোফাসসিরে কোরআন আল্লামা হযরত ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর মৃত্যু শয্যায় শয়তানের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। ফখরুদ্দীন রাজী মৃত্যু শয্যায় শয়তানের বেড়াজালে পড়লেন! তখন নিজের যোগ্যতায় তিন’শ ষাটটি দলিল উপস্থাপন করলো যে, লা-শারিক, আল্লাহ এক’। তবুও শয়তানের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না, তখনই তাঁর যোগ্যতা-সম্পন্ন পীর-মুর্শিদ হযরত শাইখ নাজিমুদ্দীন কোবরা (রহ.) প্রায় তিন’শ মাইল দূর থেকে রুহানিভাবে দেখতে পেলেন, তাঁর ভক্ত-মুরিদ ফখরুদ্দীন রাজী মৃত্যু শয্যায় শয়তানের ধোকায় পড়তে যাচ্ছে। তখন তিনি অজুর পানির ঘটি নিক্ষেপ করলেন, পানিসহ ঘটি এসে ফখরুদ্দীন রাজীর গায়ে পড়লো। ঘটির ভিতর থেকে আওয়াজ আসল, হে ফখরুদ্দীন রাজী, তুমি শয়তানকে বলো, বিনা দলিলে আমার প্রভু এক’ এবং বিশ্বাস করি তিনি অবিনশ্বর।’ ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (রহ.)-এ কথা শয়তানকে বললে, শয়তান পরাজিত হয়ে বললো --" হে ফখরুদ্দীন রাজী, যদি আজ তোমার কোন কামেল পীর-মুর্শিদ না থাকতো তাহলে তুমি কিছুতেই ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারতে না।" এভাবেই শয়তানের কবল থেকে ফখরুদ্দীন রাজীর ঈমান রক্ষা পেল। এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, মুরিদ যতই যোগ্যতা-সম্পন্ন, কেতাবি আলেম হোক না কেনো। যোগ্য পীরের সান্নিধ্য না পেলে তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা অনেক সময়ই বেকার প্রমাণিত হয়।
গুরু শিষ্যের পঞ্চম পর্বে আজ আলোচনা করব ভক্তি ও ভক্তের করণীয় সম্পর্কে :- পূজনীয় দেবতা বা ব্যক্তির প্রতি বিশেষ অনুরাগ বা প্রেমকেই ভক্তি বলা হয়।ঈশ্বরের নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের নামই ভক্তি।ভক্তির পথে যিনি ঈশ্বরোপাসনা করেন, তাঁকে ভক্ত নামে এবং ভক্তিবাদী দর্শনকে ভক্তিমার্গ নামে অভিহিত করা হয়। ভক্তিবাদ হিন্দুধর্মের একাধিক শাখাসম্প্রদায়ের মূলভিত্তি। বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভক্তিবাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে।
ইসলাম বলে মুরীদ যার অর্থ ইচ্ছাপোষণকারী অর্থাৎ পীর বা গুরুর প্রতিটি আদেশ পালনে ইচ্ছাপোষণ করাই হচ্ছে শিষ্যের কাজ।
মকতুবাতে আছে --
১)গুরু উপস্থিত থাকা অবস্থায় স্বীয় পীর ব্যাতীত অন্য কারো প্রতি লক্ষ্য করবেনা।
২)পীর উপস্থিত থাকা অবস্থায় তার অনুমতি ব্যাতীত নফল এবাদত ও জিকির আজকারে লিপ্ত হবেনা।
৩)পীরের জায়নামাজের উপর কখনো পা রাখবেনা বা দাড়াঁবেনা। পীরের সামনে কারও সাথে কথাবার্তা বলবেনা;কারও প্রতি লক্ষ্য পর্যন্ত করবে না।
৪)পীরের সামনে তাঁর বিনা অনুমতিতে পানাহার করবে না।
৫)গুরুর দিকে পা প্রসারিত করে বসবে না। সেদিকে কফ,থুতু ইত্যাদি নিক্ষেপ করবে না।
৬)পীর যে কাজ করেন না বুঝে নির্দিধায় মেনে নিতে হবে।
৭)তাকে দেখেই কর্ম শিখতে হবে যেভাবে বলবে ঠিক সেভাবে।
৮)গুরুর দোষত্রুটি অনুসন্ধান করবেনা।
৯)নিজের অলৌকিক ক্ষমতা থাকলেও গুরুর সামনে প্রদর্শণ করবেনা।
১০)যদি তার কোন বিষয়ে মনে সন্দেহ জাগে সরাসরি জিঙ্গাসা করবে।
১১)নিজের কর্মের উপর কখনও নির্ভর করবেনা।
১২)পীরের আদেশ ব্যাতীত তার নিকট হতে অন্যত্র যাবেনা।
১৩)পীরের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবেনা। এবং বাজে কথা বলা উচিত নয়।
১৪)মুরীদের জন্য পীরের খেদমত এবং গুরু ভাইদের প্রতি সদাচরণ প্রদর্শন করা অবশ্য কর্তব্য।
আবু ইসহাক ইব্রাহীম রহ: সাযরোনের কুতুব ছিলেন তিনি তাঁর মুরীদগণকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা কখনও মেহমান ছাড়া আহার করবেনা। কিন্তু এক মুরীদ বন্ধুর দাওয়াত রক্ষা করতে দাওয়াত গ্রহণ করল যেখানে কোন মেহমান ছিলনা। একাই খেয়ে আসল। দুদিন পর এক ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হলে মুরীদকে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিল। গুরুর কাছে খবর আসা মাত্র গুরু বললেন মেহমান ছাড়া খেলে যা হয় বলেছিলাম।
গুরুর আদেশ অমান্য করলে কয়েকটি বিপদ উপস্থিত হয় ১)দূর্ঘটনার শিকার হবে ২) হতাশাগ্রস্থ হয়ে জীবন কাটবে ৩) বিপদাপদ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
শাস্ত্রে আছে -যিনি মন্ত্র,তিনিই গুরু,যিনি গুরু তিনিই স্বয়ং হরি। হরি রুষ্ট হলে গুরুদেব রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু গুরু রুষ্ট হলে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন --গুর সেবা দ্বারা আমি যত তুষ্টি লাভ করি, পূজা,বৈষ্ণবদীক্ষা, সমাধি বা ভগবানে নিষ্ঠা দ্বারাও আমি তত তুষ্টি লাভ করিনা।
সেদিন প্রচন্ড গরম তাছাউফ শিক্ষাকেন্দ্রে বসে আমার গুরুজী সবাইকে দীক্ষা দিচ্ছেন। আমার শহরে জন্ম, বসবাস করার কারনে এবং বাবার আদরের দুলাল বলে নিজের হাত পাখার ব্যাবহার তেমন একটা করতে হয়নি। কিন্তু সেদিন বিদ্যুত নেই গুরুকে আমি বাতাস করছিলাম (যদিও গুরু আমাকে বাতাস করতে বলেন নি) । তো এক পর্যায়ে গুরুজী উনার গুরু খাজা ছায়েদ হোসেন চিশতী নিজামী (রহ:) কথা বলছেন যে,গুরুজী যখন তাঁর গুরুকে বাতাস করতেন তখন সবাই ঘামতেন কিন্তু তিনি ঘামতেন না। যখনই এ কথা বললেন অবাক ও তাজ্জবের কান্ড চারপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই ঘামছে কিন্তু আমি একটুও ঘামাইনি। সুবহানাল্লাহ।
কিন্তু হাত পাখাতে বাতাস করার কারণে এবং আমার অভ্যেস না থাকার কারণে আমার হাতে একটা ছোট ফুসকা পড়ে। বুঝতে পারছি পরীক্ষা চলছে। গুরুকে আর বলিনি ফুসকা পড়েছে পাশের আরেকজন দেখছে সে সময় ফুসকা কিন্তু গুরুকে বলিনি। কি বলব সেই কথা সুবহানাল্লাহ কিছুক্ষণ পড় দেখি ফুসকা নেই জ্বালাপোড়াও নেই।
তাই সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে যাদের গুরু আছে তারা গুরু নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে পালন করার চেষ্টা করবেন তবেই গুরু আপনার দিকে খেয়াল করবেন। মনের রাখবেন ভক্তের হৃদয়ের খবর গুরু জানেন।
জালালুদ্দীন রুমীকে তার পীর মদ নিয়ে আসতে বলেছিল প্রকাশ্যে পরীক্ষা করার জন্য এবং উনি পাশ করেছেন।
ঐ সময় রুমী মস্তবড় শরীয়তের মাওলানা ছিলেন। শামসেতেব্রিজ একদিন বললেন -যাওতো দেখি বাজার থেকে মদ/সুরা নিয়ে আসো। রুমী অবাক প্রশ্ন না করেই দৌড়ে চলে গেলেন মদের দোকানে। চুপটি করে জুব্বার নীচে লুকিয়ে নিয়ে এলেন মদ গুরুর কাছে আসার পর গুরু বলল কোথায় মদ তখন জুব্বার নীচ থেকে বের করলেন। তেব্রিজ রহ: বললেন এ মদ আমি ছুঁইবোনা কারন তুমি এটা লুকিয়ে এনেছ। আবার দৌঁড়ে গেলেন এবার মদ কিনে মাথায় করে নিয়ে আসছেন চারপাশে সবাই বলছে রুমী গিয়েছে বাতিল হয়ে ওর পীরও গেছে বাতিল হয়ে। মাথায় ছিল তাই সামনে এসেও মাথা থেকে নামায়নি।
গুরু রুমী কে বলল কি নিয়ে আসছ?
রুমী বলল মদ।
গুরু বলল দাও দেখি।
রুমী মাথা থেকে নামিয়ে দেখল মদ আর মদ নেই তা দুধে পরিপূর্ণ।
তেব্রিজ বলল তুমি পরীক্ষায় উত্তির্ণ হলে কারণ তোমার ভেতরে যে অহংকার ছিল যে তুমি এ শহরের মস্তবড় আলেম। তা আজ ভেঙ্গে চূর্ণ হয়েছে।
গুরু ধরলেই কল্যাণ হয়না, গুরুর কথা মানলেই কল্যাণ হয়।তার কারন গুরু হলেন শব্দ,শরীর নন।শরীরও গুরু নয়।তাই গুরুর কখনও মৃত্যু হয়না। যদি গুরু মারা যান তাহলে শিষ্যের কল্যাণ হবে কী করে? যদি কোন হাড় মাংসযুক্ত শরীর গুরু হয় তাহলে সে অধম গুরুর বেশে কালনেমী রাক্ষস।
প্রভুর কাছ থেকে লাভবান হওয়ার পাঁচটি উপায় আছে ---নামজপ,ধ্যান,সেবা,আজ্ঞা পালন এবং সঙ্গ। কিন্তু সাধু মহাত্মদের কাছ থেকে লাভবান হওয়ার তিনটি উপায়ই উপযুক্ত--- সেবা,আজ্ঞাপালন, সঙ্গ। তাই গুরুর নামযপ না করে তাঁর আজ্ঞা নির্দেশ পালন করা উচিত।গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করাই প্রকৃতপক্ষে গুরু সেবা।গুরু শরীর নন মূলত তিনি হলেন তত্ত্ব।
অনেকেই দেখা যায় গুরু তাঁর ফটো দেন গলায় পড়তে দেন,তার পূজা এবং ধ্যান করান-তিনি প্রতারণা করেন। ভগবানের চিন্ময় পবিত্র শরীর। হাড় মাংসের শরীর নয়।
গুরুতো তিনিই যিনি শিষ্যকে প্রভুর সামনা সামনি করে দেন। প্রভুর প্রতি বিশ্বাস জাগ্রত করেন। হনুমান বিভীষনের বিশ্বাসকে নিজের দিকে আকৃষ্ট না করে ভগবানের দিকে করেছিলেন।
একটি ঘটনা বলি---৫৫ বছর জল্লাদগিরি করে একজন জল্লাদ অবসরে যাওয়ার দিন ভালো এক পোশাক পড়ে তার প্রিয় খাদ্য প্রস্তুত করে খাওয়া শুরু করতে যাচ্ছিল তখনই সারিপুত্র ভন্তে ধ্যান থেকে উঠে তার দরজায় এসে দাঁড়ালেন ভিক্ষার জন্য?
জল্লাদ তাকে নিজের খাদ্য দান করল।ভন্তে তাকে ধর্মবাণী শোনাচ্ছিল কিন্তু তার মনযোগ সেই হত্যাকারী মানুষগুলোর স্মৃতিতে। যদিও হকুম দিয়েছিল রাজা।
ভন্তে ধর্মদেশনা দিতে লাগলেন ভক্তি সহকারে শুনতে শুনতে বিদর্শণ জ্ঞানলাভে সক্ষম হলো অনেকটা নির্বানের প্রথম স্তরে পড়ে যাওয়ার মত। এর পর যখন সারিপুত্র ভন্তকে বিদায় দিয়ে আসছিল পথে গাভীর শিংয়ের গুতা খেয়ে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর ভিক্ষুরা জানতে চাইল সেই জল্লাদ কোথায় জন্মেছে? বুদ্ধ বলল তার শেষ সময়ে বিদর্শণ জ্ঞানলাভের কারনে তুষিত স্বর্গে জন্ম নিয়েছে।
অতএব ভক্তিতেই মুক্তি। দেশনা গুরুর প্রতিই দেয়া হয়ে থাকে। গুরু ধরলেই কল্যাণ হবেনা যদিনা এমন কর্ম থাকে।
বাস্তবে গুরু মহিমা প্রচার করার জন্য নয়। তা ধারণ করার জন্য। বস্তুত শিষ্যের দৃষ্টিতেই গুরুর মহিমা থাকে। গুরুর দৃষ্টিতে তা থাকেনা। মূলত প্রভুর কৃপায় জীব মানব শরীর লাভ করে আর গুরুর দয়ায় প্রভূকে পাওয়া যায়।
জগাই আর মাধাই বিখ্যাত পাপী ছিল সাধুদের দেখতে পারতোনা কিন্তু গুরু চৈতন্য তাদের প্রতি দয়া করে তাদের উদ্ধার করেছিলেন।
এখানে বলে রাখি কৃপাকে কেউ দয়া ভাববেন না, দয়া আর কৃপা এক জিনিস নয়।দয়ায় থাকে কোমলতা কিন্তু কৃপায় থাকে কিছু শাসন। দয়াতে শাসন থাকেনা। দয়াতে হৃদয় বিগলিত হয় তখনই শিষ্যের কাজ উদ্ধার হয়।মানব শরীর প্রভূর কৃপায় পাওয়া যায়। জীব তা পেয়ে জান্নাত বা জাহান্নামে যেতে পারে ফল ভোগ করে মুক্ত হতেও পারে। কিন্তু গুরুর কৃপা বা সাধুর দয়ায় মানুষ স্বর্গ-নরক লাভ করেনা। মুক্তি লাভ করে।তবে স্বচেষ্ট হতে হয়।ধরুন বৃষ্টি হলে কেউ যদি তার সামনে পাত্র রাখে তবেই সে পাত্র ভর্তি হয়। কিন্তু পাত্রকে যদি উল্টো করে রাখা হয় তবে পানি সে পায়না।
সাধক গুরুর আঙ্গিনায় গেলে পূর্বের স্বভাব তখনই কেটে যায় যখন আপনার জ্ঞান পাত্রকে গুরুর সামনে মেলে ধরবেন। আবে হায়াতের পানি তখনই পূর্ণ হবে। যা পান করার পর আপনার অজানা বলে কিছু থাকবেনা।
মোজাদ্দেদে আল ফেসানীর আমলে এক লোক তবারক এর লোভে প্রতিবার সাপ্তাহিক মাহফিলে যেত।হুজুর প্রতিদিনই জিকিরের পরে কিছু বলতেন। এরুপ শুনতে শুনতে এক সময় তার বিদর্শণ জ্ঞান লাভ হয়ে যায়।তার মাঝে পরিবর্তন আসতে থাকে। সে ব্যাক্তি নামাজে যখন সেজদায় যায় অদ্ভূত সব দৃশ্য দেখতে পায়।এটাই ছিল ওর কর্মফল।
জেনে রাখবেন মানুষের জন্মজাত গুরু হল তার বিবেক। প্রভূ প্রতিটি মানুষের মাঝেই তা দিয়ে থাকেন। যে নিজের বিবেক কে শ্রদ্ধা করেন ধর্মদেশনা মানেন তাঁর গুরু তার ভেতরেই তত্ত্ব জ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়। পাপ আর অপরাধে যদিও সাধারণ মানুষের সে পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বলেই সম্যক গুরুর প্রয়োজন হয়।
মহারাজ চতুর সিংহ ভাল লোকদের সাথে চলতেন অর্থাৎ সৎসঙ্গ করতেন আর কোথাও ভাল কথা শুনলেই তা মুখস্ত করে নিতেন এবং প্রতিজ্ঞা করতেন এই কথাটি যেন জীবন থেকে চলে না যায়। এইভাবে চলার পর তিনি সাধু হয়ে গিয়েছিলেন। স্বামী রামানন্দ মহারাজ কবীরকে শিষ্য করতে অস্বীকৃত হওয়ায় কবীর একদিন পন্ঞ্চগঙ্গা ঘাটে শুয়েছিলেন। রামানন্দ গোসল করতে যাওয়ার সময় অজান্তে তাঁর পা কবীরের গায়ে লাগে এবং তিনি রাম রাম বলে উঠেন। কবীর সে নামকে গুরুমন্ত্র মনে করে সাধনায় নিমগ্ন হন।
যীশুর মহাবাণীই অবহেলিত নর্তকীর জীবনে পরম সাধনা হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে স্বর্গ রাজ্যের ঘোষণা দেন যীশু।
নিজের দ্বারা নিজের উদ্ধার ঘটাতে হবে পতন নয়।বাস্তবে মানুষ নিজেই নিজের গুরু।তবে একাকী সাধনা দুস্কর বটে। গুরুর কাছে গেলেই আপনার ভেতরে থাকা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দেবে। কীভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছবেন সে পথ তিনি বলে দেবেন। অশান্ত মনকে স্থীর করা শেখাবেন একাকী পারবেন কিন্তু কৌশলটা শেখাবেন গুরু।
যার ভেতর নিজেকে উদ্ধারের আগ্রহ থাকে সে কোনো যায়গায় আটকে থাকেনা। যুধিষ্ঠিরকে বনে তের বছর কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল।তাই কুন্তি
শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন-কানাই পান্ডবদের প্রতি কি তোমার দয়া নেই? কৃষ্ণ বললেন-আমি কী করব যুধিষ্ঠির জুয়াতে রাজ্য,ধন সম্পত্তি সবকিছু বাজি ধরেছিল কিন্তু আমাকে স্মরণই করেনি।
তাই সম্যক গুরুর প্রয়োজন আছ।
Comments
Post a Comment